জালাল উদ্দিন রুমির জীবনী । Biography of Jalal Uddin Rumi
আট শতাব্দী আগে , বর্তমান আফগানিস্তানের বালখ নামক শহরে, ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ,বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ ও মুইমিনা খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করে একটি ফুটফুটে সন্তান । বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন বালখ্ এর একজন ধর্মতাত্ত্বিক, আইনজ্ঞ, অতীন্দ্রিবাদী এবং একজন বিজ্ঞ আলেম।যিনি তার অনুসারীদের কাছে “সুলতান আল-উলামা” নামে পরিচিত ছিলেন।তাদের ফুটফুটে সন্তাটির নাম রাখা হয় মুহাম্মদ। কে জানতো তাদের এই সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু একদিন তার আধ্যত্বিকতা ও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে নিজের পিতার খ্যাতিকেও ছাড়িয়ে যাবে । এক ও অদ্বীতিয় স্রষ্ঠার খুজে নিগুর জ্ঞান পিপাসু ও আধ্যত্বিক জ্ঞানের মশালবাহী হয়ে মানবপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে ।
<iframe width="560" height="315" src="https://www.youtube.com/embed/Lfbf1alquJ0" frameborder="0" allow="accelerometer; autoplay; encrypted-media; gyroscope; picture-in-picture" allowfullscreen></iframe>
এই সেই মহান ব্যক্তিত্য, যার সময়ে তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি নামে পরিচিত ছিলেন ।
তাকে ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি ডাকা হয় “রুমি” নামে। তার পুরো নাম “জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ বালখী” বা “জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ রুমি”মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি নামে ,তবে শুধু মাত্র রুমি নামে বেশি জনপ্রিয়।।
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি তিনি ছিলেন ১৩ শতকের একজন ফার্সি মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিবাদী এবং সুফী। রুমির প্রভাব দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে আছে আজো । রুমিকে যুক্তরাষ্ট্রের “সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি”এবং “বেস্ট সেলিং পয়েট” বলা হয়।
২০০৫ সালে ইউনেস্কো তুরস্কের “মৌলভী সামা উৎসব”কে ঘোষণা করে “মৌখিক এবং স্পর্শাতীত সেরা শিল্পকর্মের মানুষের ঐতিহ্য” হিসেবে।
2007 সালকে ইউনেস্কু রুমি র্বষ হিসেবে স্বৃকীতি দেয় ।
যখন মঙ্গোল দ্বারা মধ্য এশিয়া আক্রান্ত হয়, তখন বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ তার পুরো পরিবার এবং একদল শিষ্য সহ ইরানের শহর “নিশাপুর”এ চলে যান।
নিশাপুরে থাকাকালীন রুমির সাথে তখন পরাসীর সবচেয়ে জনপ্রিয় রহস্য কবি আত্তার এর দেখা হয়। আত্তার সাথেসাথেই রুমির আধ্যাত্নিক বৈশিষ্ট চিনতে পেরেছিলেন।তিনি দেখতে পেলেন রুমি তার পিতার পিছনে হেঁটে যাচ্ছেন এবং তিনি বললেন, “একটি হ্রদের পিছনে একটি সমুদ্র যাচ্ছে”।
এই সাক্ষাত আঠারো বছরের রুমির উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং পরবর্তিতে তার কাজের উৎসাহ হিসাবে কাজ করে। রুমির পিতা ও ফার্সি কবি আত্তার ছাড়াও রুমির উপর প্রভাব ফেলেন সানাই।
১২২৮ সালের ১ মে, আনাতোলিয়া শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদ তাদেরকে আমন্ত্রণ জানান, বাহা উদ্দিন আনাতোলিয়া আসেন এবং আনাতোলিয়া এর কোনিয়াতে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন যেটি রুম সালাতানাত এর পশ্চিমাঞ্চল র্বতমানে তুরস্কে অবস্থিত।
বাহা উদ্দিন এর একজন ছাত্র, সৈয়দ বুরহান উদ্দিন মোহাক্কিক তীরমিযি, রুমিকে শরীয়াহ এবং তরীকা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে থাকেন বিশেষ করে তার পিতার দিকগুলো। নয় বছর ধরে তিনি সূফীবাদ শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর রুমির জনজীবন শুরু হয়ঃ তিনি একজন ইসলামী ফকিহ্ বা আইনজ্ঞ হন, ফতওয়া প্রকাশ করেন এবং কোনিয়ার মসজিদে নৈতিকতা বক্তৃতা দিতে থাকেন। তিনি মাদ্রাসাতে একজন মৌলভি হিসাবে কাজ করেন এবং তার অনুগামীদের শিক্ষা দেন।
রুমির জীবন ও র্দশনে যিনি তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন ,তিনি হচ্ছেন দরবেশ শামস তাবরিজ । যার সাথে সাক্ষাৎ হয় ১২৪৪ সালে যেটি তার জীবন সম্পূর্ণরুপে বদলে দেয়। দরবেশ তাবরিজীর সান্নিধ্য রুমিকে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষক এবং আইনজ্ঞ থেকে রুমি একজন সাধুতে রূপান্তরিত করেছিল।
একবার শামস তাবরীজ রুমির পাশ দিয়ে হেঠে যাওয়ার সময় দেখলেন , রুমি বই পড়ছেন , এমন সময় রুমিকে প্রশ্ন করলেন , ............তমি কি করছো ?রুমি উত্তর দিলেন , তুমি বুঝবে না । এটা জ্ঞান , যারা যানে না , তারা এটা বুঝবে না । তখন পা থেকে মাথা পযন্ত ময়লা পোষাক পরিহিত ফকির তাবরিজ রুমির সব বই পাশের পুকুরে ফেলে দিলেন ।
রুমি অবাক হযে দেখলেন একটি বইও পানিতে ভিজে নি সব বই ই শুকনো ছিল । রুমি ফকির কে প্রশ্ন করলেন , এটা কীভাবে সম্ভব ?
শামস তাবরিজ একই উত্তর দিলেন । এটা তুমি বুঝবে না । এটা জ্ঞান , যারা কিছুই জানে না তারা এটা বুঝবে না ।
তার পর থেকে রুমি একজন ফকিরের প্রেমে মজনু হয়ে গেলেন এবং উনার সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙকায়
বিহবল হয়ে পরলেন ।অবশেষে শামস তাবরিজের শিষ্য হয়ে তার কাছ থেকে সকল আধ্যাত্বিক জ্ঞান অর্জন করেন ।
১২৪৮ সালের ৫ ডিসেম্বর রাতে রুমি এবং শামস কথা বলছিলেন, এমন সময় কেউ শামসকে পিছনের দরজায় ডাকে। তিনি বের হয়ে যান এবং এরপর আর কোথাও কখনো দেখা যায়নি। গুজব শোনা যায় যে রুমির পুত্র আলাউদ্দিন এর মৌনসম্মতিতে শামসকে হত্যা করা হয় । কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন তখন তিনি অন্য কোথাও চলে যান ।
শামস এর জন্য রুমির ভালবাসা এবং তার মৃত্যুতে শোকের প্রকাশ তিনি করেছেন “দেওয়ান-এ শামস-এ তাবরিজী” কাব্যগ্রন্থে। তিনি নিজে শামসের খোঁজে বের হয়ে গেছেন এবং দামেস্ক ভ্রমণ করেছেন। সেখানে তিনি বুঝতে পারলেনঃ
আমি কেন তাকে খুঁজব?
সে আর আমি তো একই
তাঁর অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে
আমি নিজেকেই খুঁজছি
তার লেখা মসনবী কে ফার্সি ভাষায় লেখা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসাবে তুলনা করা হয়। ইরান সাম্রাজ্য এবং বিশ্বের ফার্সি ভাষার লোকেরা এখনও তার লেখাগুলো মূল ভাষায় ব্যাপকভাবে পড়ে থাকে। অনুবাদসমূহও খুব জনপ্রিয়, । তার কবিতা ফার্সি সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে, শুধু তাই নয় তুর্কি সাহিত্য, আজারবাইজান , হিন্দী , উর্দু ,বাংলা সাহিত্যকেও অনেক প্রভাবিত করেছে।
মাওলানা জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমির আধ্যাত্মিক কাব্য মসনবী শরীফকে ফার্সি ভাষার কোরআন বলা হয়। প্রাচ্যে তার সম্পর্কে বলা হয় যে সে “একজন নবী নয় কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সে একটি ধর্মশাস্ত্র নিয়ে এসেছে”
মাওলানা জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমি প্রেমের মধ্যে মুক্তি দেখেছেন এবং মানুষে মানুষে প্রেম, মানুষ-সৃষ্টিকর্তার প্রেম নিয়ে অনেক উক্তি করে গিয়েছেন। পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তা, অতীন্দিয়বাদ এবং সুফিবাদ নিয়ে করা রুমির বানী গুলো আজো জ্বলজ্বল করছে মসনবিতে। ভারতবর্ষের মুসলিম কবি ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ সহ বাংলাদেশের মরমী কবি লালন, কবি নজরুল ও রুমির মসনবীর প্রভাব থেকে বাহিরে ছিলেন না
রুমির আরেকটি প্রধান কাজ হচ্ছে “দেওয়ান-এ-কবির”(“প্রধান কাজ”) বা “দেওয়ান-এ শামস তাবরিজী”(শামস তাবরিজী এর কাজ); যেটি নামকরণ করা হয় রুমির শিক্ষক শামস তাবরিজীর নামে।
রুমি প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করতেন সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌছানোর রাস্তা হচ্ছে সঙ্গীত, কবিতা, এবং নৃত্য। রুমির কাছে, সঙ্গীত সাহায্য করে সমস্ত সত্তাকে পবিত্র করতে কেন্দ্রীভূত করে এবং এতই তীব্রভাবে যে আত্না একই সাথে ধ্বংস এবং পুনরুত্থিত হয়। এই ধারণা থেকে সূফী নৃত্য গড়ে উঠে। রুমি “সামা” সঙ্গীত পছন্দ করতেন ।
“সামা”এক ধরণের সঙ্গীত যা প্রতিনিধিত্ব করে মন এবং ভালবাসার মাধ্যমে একের নিকট আধ্যাত্মিক আরোহণের এক রহস্যময় ভ্রমণ। এই ভ্রমণে অন্বেষক প্রতিকীভাবে সত্যের দিকে ফিরে,ভালবাসা বৃদ্ধি, অহংকার পরিত্যাগ করে সত্যের সন্ধান পায় এবং নির্ভুল একের নিকট পৌছায়। এরপর অন্বেষক আধ্যাত্মিক ভ্রমণ শেষে , পরিপক্কতা লাভের মাধ্যমে সৃষ্টিকে ভালবাসতে এবং সেবা করতে শেখে।
রুমির প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল “নে”(এক ধরনের বাঁশি)।
আধ্যাত্মিক সাধক, কবি জালালউদ্দিন রুমির সুফিবাদ, অতীন্দ্রিয়বাদ, সৃষ্টিকর্তা এবং মানুষের প্রতি প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, সমাজ, জীবন দর্শন নিয়ে রুমির উক্তি আজো মানুষকে আলোর পথ দেখায়।
যেমন তিনি বলেন :
“যখন তুমি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন থাকবে, তখন ধৈর্য্য ধরবে। ধৈর্য্যের চাবি সুখের দরজা খুলে দেয়।”
“যত বেশি নীরব হবে, তত বেশি শুনতে পাবে!!!”
“জম্ম হয়েছে তোমার পাখা নিয়ে। উড়ার ক্ষমতা তোমার আছে তারপরেও খোঁড়া হয়ে আছো কেন!
“যদি আলো থাকে তোমার হৃদয়ে তাহলে ঘরে ফেরার পথ তুমি অবশ্যই খুঁজে পাবে।”
“মোমবাতি হওয়া সহজ কোন কাজ নয়। আলো দেওয়ার জন্য প্রথম নিজেকেই পুড়তে হয়।”
রুমি বলেন
“বৃক্ষের মতো হও, আর মৃতপাতাগুলো ঝরে পড়তে দাও।”
“একাকী বোধ করো না, কারন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড তোমার ভিতরেই বিদ্যমান।।”
“তুমি এ ব্রহ্মান্ডে গুপ্তধনের খোঁজ করছো, কিন্তু প্রকৃত গুপ্তধনতো তুমি নিজেই।
“তুমি কি তোমার আত্মার খোঁজ করছো?
তবে তোমার মনের খাঁচা থেকে অবমুক্ত হও।”
“মানবপ্রেমী রুমির জীবন এবং দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শিক্ষা দেয় কিভাবে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং সুখ পাব যাতে করে আমরা ক্রমাগত শত্রুতা এবং ঘৃণার প্রবাহ বন্ধ করতে পারি এবং সত্যিকারের বিশ্ব শান্তি এবং ঐক্য অর্জন করতে পারি।
১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩ সালে এই মহান জ্ঞানী র্দাশনিক কোনিয়ায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন । তাকে কোনিয়ায় সমাহিত করা হয় এবং সেটি এখন একটি তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে।
তার সমাধি দেখতে আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম-অমুসলিমরা ছুটে যান।
তাকে তার পিতার কাছে সমাহিত করা হয় এবং যেটি একটি চমকপ্রদ ঘর, “ইয়াসিল তুর্ব”(সবুজ সমাধি, যা বর্তমানে মাওলানা মিউজিয়াম), তার কবরের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
তার সমাধিফলকে লেখাঃ
যখন আমি মৃত, পৃথিবীতে আমার সমাধি না খুঁজে, আমাকে মানুষের হৃদয়ে খুঁজে নাও।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন